মোটরসাইকেল যারা চালান, তারা সবাই ইঞ্জিন অয়েলের সাথে পরিচিত। আমাদের দেশে ইঞ্জিন অয়েল মোবিল নামেই পরিচিত বেশি, যদিও মোবিল একটি ব্র্যান্ডের নাম। ইঞ্জিন অয়েল মোটরসাইকেলের দীর্ঘস্থায়িত্ব ও সঠিক পারফরমেন্স নিশ্চিত করার সবচেয়ে বেসিক এবং গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। আজ আমরা কথা বলব ইঞ্জিন অয়েলের গ্রেড, ড্রেইন ইন্টারভাল, বিভিন্ন ধরণের ইঞ্জিন অয়েলের কার্যকারিতানিয়ে।
প্রথমেই আসা যাক ইঞ্জিন অয়েলের গ্রেড নিয়ে। বাংলাদেশের অন্যতম বিতর্কিত একটি বিষয়। কোন গ্রেড ব্যবহার করবো, কেন করবো। অন্যটি কেন করবো না। এর সবচেয়ে সহজ উত্তর হচ্ছে আপনার বাইকের ইঞ্জিন স্ট্রাকচার। আপনার মোটরসাইকেলটি তৈরি করার আগে ম্যানুফ্যাকচারাররা কোটি কোটি ডলার খরচ করে রিসার্চ করেছে এবং আপনার ইঞ্জিনের জন্য সবচেয়ে ভালো কি হবে সেগুলো নির্ধারন করেছে। তাই বাইকের ইউজার ম্যানুয়ালে যে গ্রেড লেখা থাকবে, সব সময় সেই গ্রেড ব্যবহার করবেন। অনেক বাইকের ম্যানুয়াল থাকে দুইটি। একটি ইউজার ম্যানুয়াল, একটি সার্ভিস ম্যানুয়াল। সার্ভিস ম্যানুয়াল সাধারণত দেশে তৈরি করা হয় আর এখানে গ্রেড বদলে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সব সময় ইউজার ম্যানুয়াল অনুযায়ী ইঞ্জিন অয়েল দিবেন। উদাহরণস্বরুপ একটি গ্রেড নিয়ে দেখা যাক গ্রেডের নাম্বারগুলোর আসলে কি বোঝায়।
10W30 বলতে কি বোঝায়?
বাংলাদেশের রাস্তায় চলা বাইকের একটি বড় অংশ এই 10W30 ইঞ্জিন অয়েল ব্যবহার করে। এই 10W30 একটি মাল্টিগ্রেড ইঞ্জিন অয়েল, যেখানে Wহচ্ছে Winter। Wএর আগে যেই সংখ্যাটি থাকে সেটি নির্ধারন করে ঠান্ডা আবহাওয়ায় আপনার ইঞ্জিন কেমন পারফর্ম করবে। সংখ্যাটি যত ছোট, ঠান্ডায় পারফরমেন্স তত ভালো। সবদিক বিবেচনা করে Wএর আগের সংখ্যাটির মাহাত্ব খুব একটা বেশি নয়। আসল সংখ্যা হচ্ছে Wএর পরের সংখ্যাটি। এটি বোঝায় ১০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় অয়েলের ভিস্কোসিটি (প্রবাহ/সান্দ্রতা) কেমন হবে। সংখ্যাটি যত বড় হবে, ১০০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে অয়েলের সান্দ্রতা তত বেশি হবে। সান্দ্রতা হচ্ছে অয়েলের ফ্লো হওয়ার ক্ষমতা। Wএর আগের সংখ্যাটি পরিবর্তন হলে কোন সমস্যা না হলেও পরের সংখ্যাটি পরিবর্তন করলে বাইকের পারফরমেন্স এবং দীর্ঘস্থায়িত্ব নষ্ট হয়ে যাবে। কারণ ইঞ্জিনের ভিতরের ছোট ছোট মিলিমিটার সাইজে গ্যাপ থাকে, সেখান দিয়ে অয়েল সার্কুলেট হয় এবং ইঞ্জিনে প্রোপার লুব্রিকেশন হয় এবং ইঞ্জিন ঠান্ডা থাকে। Wএর পরের সংখ্যাটি পরিবর্তন হয়ে গেলে ইঞ্জিন গ্যাপ দিয়ে অয়েল ঠিক মত ফ্লো করতে পারবে না, এতে সাউন্ড স্মুথ মনে হলেও ভবিষ্যতে ইঞ্জিনের বড় ধরণের ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
ড্রেইন ইন্টারভালঃ
ড্রেইন ইন্টারভাল বলতে বোঝায় কত কিলোমিটার পর পর ইঞ্জিন অয়েল পরিবর্তন করবেন। উন্নত দেশগুলোতে ড্রেইন ইন্টারভাল অনেক বেশি হয় এবং তারা নিয়মিত ইঞ্জিন অয়েল টপ আপ করে। মোটরসাইকেল চলতে চলতে ইঞ্জিন অয়েলের পরিমাণ কমে যাওয়াটা খুবই সাধারণ একটি ব্যাপার, কারণ পিস্টন রিং এর পাশ দিয়ে সামান্য অয়লে ইঞ্জিনের ভেতর বার্ন হয়। আমাদের দেশের পরিপ্রেক্ষিতে টপ আপের নিয়মটি নেই বললেই চলে। বাইকের ম্যানুয়ালে সাধারণ ড্রেইন ইন্টারভাল লেখা থাকে ৬০০০-১০,০০০ কিলোমিটার, যা টপ আপের কথা চিন্তা করে লেখা। কিন্তু আমরা যদি সেই অনুযায়ী ড্রেইন দেই, তাহলে ইঞ্জিনের বারোটা বাজতে সময় লাগবে না। তীব্র যানজট, ভাঙ্গাচোরা রাস্তা ইত্যাদি মিলিয়ে আমাদের ইঞ্জিন অয়েলের ভিস্কোসিটি খুব তাড়াতাড়ি নষ্ট হয়ে যায়। তাই সময় মত ইঞ্জিন অয়েল পরিবর্তন করা খুবই জরুরি।
ক্লাসিফিকেশনঃ
বাজারে সাধারণত তিন ধরণের ইঞ্জিন অয়েল পাওয়া যায়। মিনারেল, সেমি-সিন্থেটিক এবং সিন্থেটিক।
মিনারেল অয়েলঃ মিনারেল অয়েল হচ্ছে ক্রুড অয়েলকে সামান্য রিফাইন করে যা বাজারজাত করা হয় এবং এর দাম বেশ সস্তা। সিংহভাগ মোটরসাইকেল ম্যানুফ্যাকচারার মিনারেল অয়েল রিকমেন্ড করে থাকে। বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে একটি মিনারেল ইঞ্জিন অয়েল ৮০০-১০০০ কিলোমিটারের ভেতর পরিবর্তন করা উচিত।
সেমি-সিন্থেটিক অয়েলঃসেমি-সিন্থেটিক অয়েল মিনারেল অয়েলকেই আরও কয়েক ধাপে রিফাইন করে এবং অ্যাডিটিভ যোগ করে তৈরি করা হয়। এর ড্রেইন ইন্টারভাল মিনারেলের চেয়ে বেশি এবং দামও বেশি। সাধারণত একটি সেমি-সিন্থেটিকইঞ্জিন অয়েল ২০০০-২২০০ কিলোমিটার চালানো যায়।
সিন্থেটিক অয়েলঃসিন্থেটিক অয়েল পুরোপুরি ল্যাবে তৈরি এবং সর্বোচ্চ পারফরমেন্স নিশ্চিত করে। এটির ড্রেইন ইন্টারভাল তুলনামূলক অনেক বেশি এবং দামও বেশ খানিকটা বেশি। সিন্থেটিক সাধারণত লিকুইড কুলড বাইকে ব্যবহার করা হয়।
সাধারণ এয়ার কুলড বাইকে সেমি-সিন্থেটিকের উপরের ইঞ্জিন অয়েল ব্যবহার করা উচিত নয়। কারণ, পর্যাপ্ত কুলিং এর অভাবে সিন্থেটিক অয়েলের অ্যাডিটিভ বার্ন হওয়ার সম্ভাবনা থাকে যা অয়েলের গুনমান দ্রুত নষ্ট করে দেয়। এছাড়াও মটরসাইকেলে কখনও গাড়ির ইঞ্জিন অয়েল ব্যবহার করা উচিত নয়। গাড়ির ইঞ্জিন অয়েল এবং ট্রান্সমিশন অয়েল আলাদা থাকে। কিন্তু বাইকের ক্ষেত্রে ইঞ্জিন অয়েল দ্বারাই ট্রান্সমিশন লুব্রিকেট হয়, যারা জন্য আলাদা কিছু অ্যাডিটিভ প্রয়োজন হয় এবং তা গাড়ির ইঞ্জিন অয়েলে থাকে না। সাধারণত MA2/JASO সার্টিফাইড হলে সেগুলো মোটরসাইকেলের ইঞ্জিন অয়েল হিসেবে নিঃসন্দেহে ব্যবহার করা যায়।
সব সময় অরিজিনাল ইঞ্জিন অয়েল ব্যবহার করুন, সময় মত পরিবর্তন করুন। আপনার মোটরসাইকেল অনেক দিন ভালো থাকবে। আপনার যাত্রা নিরাপদ হোক। এনট্র্যাকের সাথেই থাকুন।